ছোটবেলা থেকেই চালাক বা কৌশলী পাখি বলতে কোকিলকেই জেনে এসেছি। কেননা, দাদি-নানিদের কাছে শুনে এসেছি এ পাখি এতোটাই চালাক যে, নিজের বাসায় ডিম না দিয়ে কাকের বাসায় ডিম দেয়। নিশ্চয়ই মাথায় প্রশ্ন আসে, কেনো কোকিল কাকের বাসায় ডিম দেয় বা পাড়ে?
আজকে আমরা এ বিষয়টাই জানবো–
বেশির ভাগ পাখিদের একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য আছে। ডিম পাড়ার সময় হলেই তারা নিজের বাসা তৈরির কাজে লেগে যায় খড়কুটো দিয়ে। তারপর ডিম পাড়ে, ডিমে তা দেওয়া, ডিম ফুটে বাচ্চা জন্ম নিলে বাচ্চার জন্য খাবার জোগাড় করে আনে, যত্ন করে বড় করে তোলে। কিন্তু কোকিলের মাঝে এ আগ্রহ বা প্রবণতা দেখা যায় না।
এখন ভাবছেন কোকিলের মাঝে এ প্রবণতা কেনো দেখা যায় না?
সব জীবরেই সহজাত প্রবণতা গুলো জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে হরমোনের প্রভাবেও কাজগুলো হয়ে থাকে। যেমন-পাখিদের ক্ষেত্রে ডিমে তা দেওয়া, ছানা পরিচর্যা এসবের পেছনেও হরমোন কাজ করে।
প্রোল্যাকটিন নামের হরমোন দ্বারাই পাখিদের এসব সহজাত কাজ নিয়ন্ত্রণ হয়। প্রোল্যাকটিন ক্ষরণ হয় পাখিদের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে।
তবে কিছু প্রজাতি রয়েছে, যাদের এ হরমোন কাজ করেনা। যেমন-ব্রুড প্যারাসাইট পাখি। এরা নিজেরা বাসা না বানিয়ে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং তার দ্বারাই নিজের সন্তান বড় করে নেয়। অন্য পাখির দ্বারা সন্তান বড় করিয়ে নেয় বলে, অন্য পাখিটিকে পোষক পাখি বলে। কোকিলের ক্ষেত্রে প্রোল্যাকটিন কাজ করে না। আর কোকিল হলো ব্রুড প্যারাসাইট পাখি।
প্রোল্যাকটিন হরমোন নিঃসৃত হয় না কোকিল এবং তার সমগোত্রীয় এ প্রজাতি পাখিদের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে । এদের ভেতরে মাতৃত্বের দায়িত্ববোধ জন্মায় না এ কারণেই।
মাতৃত্ব না জাগলেও প্রাকৃতিক কারণে এদের প্রজনন প্রক্রিয়ার কাজ চলতে থাকে ফলে এদের ডিম তৈরি হয় এবং ডিমপাড়ে। আর নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে।
যেহেতু এদের নিজের বাসা নেই তাই ডিম দেবে কোথায় আর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবেই বা কি করে? এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য এরা এদের ডিমের সাথে মিল আছে এমন পাখি খুঁজে বের করে আর তাদের বাসায় ডিম পারে। এরা ডিম পাড়ে যেসব পাখির বাসায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য পাখি হলো কাক।
এ ক্ষেত্রে কোকিল কাকেদের বোকা বানায়।
বাংলাদেশের কোকিলরা কাক ছাড়াও শালিক, কসাই পাখি এবং ছাতার পাখির বাসায় ডিম দেয়। আর ভারতীয় প্রজাতির কোকিলরা কাকের বাসায় ডিম পারে। তবে এ পাখিদের বাসায় সুযোগ না পেলে, শেষ আশা হিসাবে ফিঙে, দোয়েল, বেনে বৌ, বুলবুলি পাখির বাসায়ও ডিম পাড়ে।
কোকিলেরা মোটে ৪-৬টা ডিম পাড়ে। আর একটি বাসায় দুটির বেশি ডিম দেয়না। তবে ঐ বাসায় ডিম পাড়ার আগে বাসার দুটি ডিম অবশ্যই ফেলে দেয় অর্থাৎ গুণে গুণে নিজের ডিমের সংখ্যার সমান করে। এই দুই দিনের মাঝেই অন্য বাসা খুঁজে নেয়। আর যদি কোন বাসায়ই খুঁজে না পায় তাহলে মাটিতে পাড়েই নষ্ট করে ডিম।
কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়, এক বাসায় দুয়ের অধিকও ডিম পাড়ে। প্রথমত, কাক গুণতে জানেনা আর ডিমের মিল থাকায় তার নিজের ডিমও চিনতে পারেনা। তাই অতিরিক্ত এই ডিমসহ কাক, ছাতার বোকার মতো ঠিকই কোকিলের ডিমে তা দেয়, বাচ্চা ফোটায় আর যত্নে লালন-পালন করে।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, কত সুবিধা! কোন ঝামেলা ছাড়াই বাচ্চা লালন-পালন হচ্ছে? আসলে তা না। এই ডিম পাড়ার ক্ষেত্রে কোকিলদের বিশেষ কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
কি সেই কৌশল?
সত্যিই কি অন্যের বাসায় ডিম পাড়া এতো সহজ? না, ডিম পাড়ার আগে কোকিলকে বাসা খোঁজার জন্য বা উপযুক্ত বাসা খুঁজতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। অর্থাৎ কাকের কোন বাসায় সদ্য ডিম পাড়া হয়েছে তা খুঁজে বের করা। তাই কোকিলকে যদি কাক তার বাসার আশেপাশে দেখে তখন সে সতর্ক হয়ে যায়। কেননা,কাকও কোকিলের মতলব বুঝে।
এ সময় পুরষ কোকিল কুউউ কুউউ ডাক ছেড়ে কাককে অর্থাৎ বাসার মালিককে ক্ষেপিয়ে তোলে। কাকেরা তখন রেগে গিয়ে পুরুষ কোকিলকে ধাওয়া করতে যায়। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় স্ত্রী কোকিল। এটুকু সময়ের মাঝেই কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে।
এবার ভাবেন,আসলেই কেকিল কতোটা চালাক?
কোকিলের ডিম থকে বাচ্চা হতে সময় লাগে প্রায় তেরো দিনের মতো। কিন্তু কাক ও ছাতারের লাগে আরও বেশি সময়। এদের ডিম আগে ফোটে বলে,কাকেদের কাছ থেকে এদের ছানারা বাড়তি খাতির-যত্ন পায় এবং বেড়েও ওঠে আগে। বাচ্চাদের গায়ে লোম না থাকায়, কাক চিনতে না পেরে পরম মমতায় বড় করে। বোকা কাক না পারলো ডিম চিনতে আর না পারলো বাচ্চা চিনতে!
কোকিলের বাসাহীন ঘুরে বেড়ানো অর্থাৎ বাউল স্বভাবের জন্য ও ফাঁকিবাজির কারণে মানুষ ‘বসন্তের কোকিল’ নামে উপমা দিয়েছে ওদের।