বর্তমান সময়ে মানুষ স্বাস্থ্য নিয়ে একটু সচেতন হয়েছে। কেননা, রোগব্যাধি যেন নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কি খেলে বা খাবারে কি কি উপাদান রাখলে শরীরে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে, এটাই ভাবনা।
আর ভাবনাতেই খাবারে যুক্ত হয়েছে এক সুপারফুড চিয়া সিড। যারা স্বাস্থ্য সচেতন, তাদের খাবারের তালিকায় ‘চিয়া সিড’ এখন বেশ জনপ্রিয়।
চিয়া সীড কি
চিয়া সিড হলো মরুভূমিতে জন্মানো সালভিয়া নামক এক ধরনের উদ্ভিদের বীজ। তবে এটি ভোজ্য বীজ হিসাবেই পরিচিত। যা পুদিনা পরিবারের ( লামিয়াসেই ) মধ্য ও দক্ষিণ মেক্সিকো সালভিয়া কলম্বিয়ারিয়া ফুলের একটি উদ্ভিদ। মধ্য আমেরিকার অনেক অংশেও এটি পাওয়া যায়।
চিয়া বীজ দেখতে ছোট চ্যাপ্টা ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। অনেকটা তিলের দানার মতো। এর গড় ওজন ১.৩ মিগ্রাম। এগুলি বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। যেমন- বাদামি, ধূসর, কালো এবং সাদা।
বীজগুলি হাইড্রোফিলিক অর্থাৎ পানি কর্তৃক আকর্ষী হয়। বীজগুলোকে যদি ভেজানো হয়, তাহলে এগুলি তার ওজনের ১২ গুণ পর্যন্ত তরল শোষণ করে থাকে। আর এগুলো অনেকটা জেলের মত হয়।
চিয়া বেশিই ভাগ ক্ষেত্রে সালভিয়া হিস্পানিকা নামে পরিচিত হলেও, চিয়াকে উল্লেখ করা হয় গোল্ডেন চিয়া বা সালভিয়া কলম্বিয়ারিয়া নামে। আর খাবারের জন্য ব্যবহৃত হয় এই সালভিয়া কলম্বারিয়ার বীজগুলি ।
প্রাক-কলম্বিয়ার যুগে এ ফসলের ব্যাপক চাষ হত অ্যাজটেকদের মাধ্যমে। আর মেসোয়ামেরিকান সংস্কৃতিগুলির প্রধান খাদ্য ছিল এ বীজগুলি। চিয়া বীজ বাণিজ্যিকভাবে মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে চাষ করা হয়।
বাণিজ্যিকভাবে একবিংশ শতাব্দীতে চিয়া মেক্সিকো এবং গুয়াতেমালার পাশাপাশি বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় উৎপাদিত হয় এবং খাওয়াও শুরু হয়।
পেটের ক্ষুধা মেটানোর পাশাপাশি রূপচর্চায়ও চিয়া সিড ব্যবহার করা হতো।
পুষ্টিগুণ
পুষ্টিকর খাবার হিসাবে চিয়া সিডের তুলনা হয় না। প্রাচীন অ্যাজটেক জাতির কাছে এর মূল্য সোনার চেয়েও বেশি ছিল।
আমরা জানি, বীজ জাতীয় যেকোনো খাবারই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। শুকনো চিয়া বীজে থাকে জল ৬%, কার্বোহাইড্রেট ৪২%, প্রোটিন ১৬% এবং ফ্যাট ৩১%। এছাড়াও চিয়া সিডে আছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, কেম্পফেরল, কোয়েরসেটিন, পটাশিয়াম, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড ও ক্যাফিক অ্যাসিড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় খাদ্য আঁশ।
খাবার হিসাবে চিয়া সীডের ব্যবহার
১. চিয়া বীজ প্রধানত তেলের ফ্যাটি অ্যাসিড। চর্বি হিসাবে লিনোলিক অ্যাসিড মোট ফ্যাটের ১৭-২৬% এবং লিনোলেনিক অ্যাসিড ৫০-৫৭% অসম্পৃক্ত অবস্থায় থাকে। উদ্ভিদ উৎস হিসাবে চিয়া বীজ ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার হিসাবে কাজ করে।
২. চিয়া বীজের নিজস্ব কোন স্বাদ না থাকায় সরাসরি ভিজিয়ে খাওয়া ছাড়াও অন্যান্য খাবারের সাথে যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন- নাস্তা সিরিয়াল, এনার্জি বার, গ্রানোলা বার, দই, টর্টিলাস এবং রুটিতে রাখা যায়।
৩. এগুলি জেলটিন- জাতীয় পদার্থ তৈরি ব্যবহার করা যেতে পারে।আবার কাঁচাও খাওয়া যেতে পারে। পুষ্টি সরবরাহে গ্রাউন্ড বীজের জেল ব্যবহার করা যেত পারে।
৪. ওটস, পুডিং, জুস, স্মুথি ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়েও খাওয়া যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন খাবারের ওপরে ছড়িয়েও খাওয়া যায়। যেমন- টকদই, সিরিয়াল, রান্না করা সবজি বা সালাদে।
৫. টক দই, চিয়া সিড ও শসা দিয়ে স্মুথি বানিয়ে এ সুপারফুডটি বিকেলের নাশতা হিসেবেও খাওয়া যেতে পারে ।
৬.এছাড়াও কেকজাতীয় খাবারে ডিমের পরিমাণ কমায় এবং নিরামিষ বেকিংয়ের একটি বিকল্পও বলা যায়।
উপকারিতা
১. চিয়া সিডে থাকা ওমেগা-৩ হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরল দূর করতে কাজ করে। এতে স্যালমন মাছের চেয়ে ৮ গুণ বেশি ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি।
২. এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রয়োজন। যা চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে।
৩. ওজন কমাতে মেটাবলিক সিস্টেম সহায়তা করে। চিয়া সিড মেটাবলিক সিস্টেমকে উন্নত করতে সাহায্য করে।
৪. এটি ডায়বেটিসের ঝুঁকি কমায়। কারণ এটি রক্তে চিনির প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
৫. এতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকায় হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় দারুণ কাজ করে। এতে দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
৬. কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে চিয়া সিড বেশ কার্যকরী। কেননা, চিয়া সিড কোলন পরিষ্কার রাখতে কাজ করে থাকে।
৭. তাছাড়া চিয়া সিড শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে আনতে কাজ করে। আর গ্যাসের সমস্যা কমানোর পাশাপাশি ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। এবং ত্বক, চুল ও নখ সুন্দর রাখতে এটি বেশ কার্যকরী।
খাওয়ার নিয়ম
১. শরীরের শক্তি এবং কর্মক্ষমতা বাড়াতে দিনে দুই চা চামচ চিয়া সিড খাওয়া যেতে পারে। তবে খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
২. বিশেষজ্ঞদের মতে, সকালে ও রাতে ঘুমানোর আগে খালি পেটে ১ গ্লাস পানির মধ্যে ২ চা চামচ চিয়া সিড ও ২ চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খেলে দ্রুত ওজন কমতে সহায়তা করে।
৩. ২০ থেকে ৩০ মিনিট কুসুম গরম পানিতে চিয়া সিড ভিজিয়ে রাখুন। তারপর সকালে খালি পেটে অথবা রাতে ঘুমানোর আগে পান করুন।
এতোই যার পুষ্টিগুণ, তাহলে তো চোখ বন্ধ করে খাওয়া যেতেই পারে-এমনি হয়ত অনেকে ভাবছেন? আর মনে করছেন যত বেশি খাবো, ততই উপকার পাবো। এটা কিন্তু ঠিক না, প্রতিটা জিনিসের কিছু অপকারও রয়েছে।
তাহলে উপকারী এই খাবারটির কিছু পার্শ্ব- প্রতিক্রিয়া জেনে নেই-
১., অধিক পরিমাণে চিয়া সিড খেলে প্রোটেস্ট ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সার বাড়তে পারে।
২. বীজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় এটি পরিমাণে বেশি খেলে পেটের সমস্যাও হতে পারে।
৩. পরিমাণের মাত্রা বেড়ে গেলে ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যেতে পারে।
৪. চিয়া সিড যেহেতু দেহের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। সেহেতু পরিমাণে বেশি হলে রক্তচাপ বেশি কমে যেতে পারে।
৫. যাদের অ্যালার্জি জনিত সমস্যা আছে, তা বেড়ে যেতে পারে।
একটু সচেতন হয়ে সঠিক নিয়ম মেনে যদি চিয়া সিড খাওয়া যায়, তাহলে এর পার্শ্ব- প্রতিক্রিয়া এড়ানো সম্ভব।
কিনতে এখানে ক্লিক করুন।