কাসাভা (Cassava) নামটি আমাদের এ অঞ্চলে বেশ অপরিচিত। দেখতে অনেকটা আলুর মত। তবে তা আটা বা গমের বিকল্প খাবার। অনেকের কাছে এটি শিমুল আলু, কাঠ আলু নামে পরিচিত। খাদ্য হিসেবে কাসাভার পরিষ্কার টিউবার সরাসরি বা সিদ্ধ করে, এমন কী কাঁচাও খাওয়া যায়।
আমাদের দেশীয় খাবারের তালিকায় অপরিচিত নাম হলেও আফ্রিকার প্রায় ৮০ কোটি মানুষের প্রধান একটি খাদ্য এই কাসাভা। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ায় কাসাাভার তৈরি খাবার বেশ জনপ্রিয়।
খাবার হিসেবে কাসাভা জনপ্রিয় হলেও তা কি আসলেই আটা বা ময়দার বিকল্প হতে পারে। আজকে জানাবো তারই বিস্তারিত।
Cassava আসলে কি?
দক্ষিণ আমেরিকার (spurge) পরিবারের অরণ্যময় গুল্ম এবং বহুবর্ষজীবী একটি উদ্ভিদ। এটি ক্রান্তীয় অঞ্চলের ফসল। চাল ও ভুট্টার পর এর অবস্থান। বার্ষিক ফসল হিসেবের কাসাভার চাষ করা হয়।
কাসাভাকে manioc বলা হয়। পাতাগুলি পালমেট বা পাখার আকৃতির। অনেকটা ক্যাস্টর-অয়েল উদ্ভিদের মতো। দেখতে অনেকটা মিষ্টি আলুর আর ব্রাজিলীয় অ্যারারুট মানিয়ক অথবা ট্যাপিওকা গাছের শিকড়ের মত। এগুলো এক ধরনের আলু। সাধারণত মাটির নিচে জন্মে। খাদ্য শর্করার একটি প্রধান উৎস অর্থাৎ তৃতীয় বৃহত্তম উৎস বলা হয় কাসাভাকে।
আমাদের দেশে খুব বেশি প্রচলন না হলেও উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রধান খাদ্য হলো এই শিমুল আলু। যা মৌলিক খাদ্য হিসেবে ৫০-৮০ লক্ষ মানুষের কাছে বিবেচিত। খরা সহনশীল ফসল যদি খোঁজা যায়, তাহলে এর নাম সবার আগে আসবে। যা প্রান্তিক মাটিতে জন্মাতে সক্ষম। বিশ্বে কাসাভার বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ হলো নাইজেরিয়া। আর বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হলো থাইল্যান্ড। তবে উগান্ডাতে এর চাষ হয়।
কাসাভার ইতিহাস
ধারণা,মায়া সভ্যতাতেই সর্বপ্রথম কাসাভা চাষের শুরু। যার প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ আমেরিকায় এর চাষ শুরু হয়। পরে পর্তুগিজদের মাধ্যমে ভারতে চাষ হয়। আর বাংলায় চাষ শুরু হয়, উনিশ শতকের শেষেরদিকে খ্রিষ্টান মিশনারিদের হাত ধরে।
কি কি কাজে ব্যবহৃত হয়
কাসাভা থেকে যে স্টার্চ পাওয়া যায় তা কাগজ শিল্পে, বেকারি শিল্পে, ঔষধ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিমেন্টের গুণগত মানোন্নয়ন, কাগজ, আঠা, প্রসাধন, রাবার ও সাবান শিল্পেও এটি ব্যবহার করা হয়।
তাছাড়া এর প্রক্রিয়াজাত পাতা ও বাকি অংশ ব্যবহার করা হয় জৈব সার তৈরিতে। মুরগি, গরু, মহিষ, ছাগল, মাছ, ইত্যাদির জন্যও কাসাভার মূল বা আলুর পিলেট, আটা বিকল্প খাবার। এর স্টার্চ দিয়ে মল্টোজ, লিকুইড, গ্লুকোজসহ বিভিন্ন রূপান্তরিত চিনি তৈরিতে ব্যবহৃত করা হয়।
সামরিক ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার লক্ষণীয়। বুলেট ডিটোনেশন কাজে ব্যবহৃত মোমবিহীন চাঁচ হিসেবে সমরাস্ত্র কারখানায় কাসাভার স্টার্চ ব্যবহার করা যায়।
কাসাভার তৈরি খাবার
কাসাভা থেকে জুস, জ্যাম-জেলি, গ্লুকোজ, অ্যালকোহল, আটা, গাম বিভিন্ন খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ব্যাপকভাবে। তাছাড়া এর স্টার্চ/আটা গমের আটার সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয় রুটি, পরটা, কেক ইত্যাদি। এগুলোর পাশাপাশি কাসাভা থেকে বার্লি, সুজি, রুটি, নুডলস, ক্র্যাকার্স, কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, পাঁপড়, চিপসসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরি করা হয়।
তাছাড়া সরাসরি অন্যান্য সবজির মত এটিও রান্না করে খাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, শুটকি ও মাংস দিয়েও রান্না করা যায়। অনেকে আবার মিষ্টি আলুর মত পুড়িয়ে খান।
জনপ্রিয় একটি খাবার সাবুদানা। এটি দিয়ে নানা ধরনের খাবারো তৈরি করা যায়। জানেন কি এই সাবুদানা কি থেকে তৈরি হয়?
সাবুদানা তৈরীর প্রধান উপকরণ কাসাভা।
বাংলাদেশে কাসাভা চাষ
শুরুতেই কাসাভার চাষাবাদ বাণিজ্যিকভাবে হয়নি। স্বল্প পরিসরে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলায় চাষ করা হলেও বর্তমান সরকারি এবং বেসরকারি দু’ভাবেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে কাসাভার বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয় কুমিল্লা, পঞ্চগড়, চট্টগ্রাম, সিলেট সহ পাহাড়ি এলাকাগুলোতে।
মাত্র ৮/১০ বছর আগে আমাদের দেশে কাসাভার চাষ শুরু হলেও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে দেশে ০.০৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে ০.৪৬ লক্ষ টন কাসাভা উৎপাদন হচ্ছে। অর্থাৎ দেশের মোট চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ।
চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশে বেশ কয়েক ধরনের কাসাভার চাষ হলেও ফিলিপাইন থেকে আসা দুইটি জাতই বেশি চাষ হয়।
আর এটি সবচেয়ে বেশি চাষ হয় পাহাড়ি এলাকায়। আর এর চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী অঞ্চল হলো উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া অঞ্চল। পাহাড়ি এলাকায় যে জুমচাষ হয়, এই আলুটি সেই পদ্ধতিতেই চাষ হয়ে থাকে ব্যাপকভাবে। পাহাড়ের প্রায় সব রকম জায়গায় অর্থাৎ উঁচু মাটি ও বেলে দোআঁশ সবটাতেই কাসাভা আলু চাষ করা হয়।
এটি জলাবদ্ধতা এবং উচ্চ লবণাক্ততা একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। জমিতে যদি পানি জমে থাকে তাহলে গাছ পচে মারা যায়।
সব ফসলে যেমন ফুল ও ফল হয়, কাসাভা গাছেরও তেমনি ফুল ও ফল ধরে। তবে ফল ধরলেও তা থেকে এই আলু চাষ করা হয় না। আর যদি ফল থেকে চাষ করা যায় তাহলে গাছ বড় হতে সময় লাগে অনেক। তাই কাসাভা চাষ করতে হয় গাছের কাটিং জমিতে রোপণ করার মাধ্যমে। আর এই আলু তোলার উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। তবে আলু তোলা শেষ হলে, ঐ গাছের ২/৩ ফুট উচ্চতা করে কেটে একটি ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় এর কাটিং অংশ পুঁতে রাখতে হয়। তারপর এপ্রিল মে মাসে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালের শেষের দিকে এই কাটিং তুলে রোপণ করতে হয় মূল জমিতে। তবে কাসাভা চাষে তেমন বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। আর লাগানোর এক বছর পরেই ফলন পাওয়া যায়।
প্রস্তুত প্রণালী
কাসাভার প্রস্তুত প্রণালি একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ফসল জমি থেকে সংগ্রহ করার পর মেশিনের সাহায্যে ছালগুলো পরিষ্কার করে নেয়া হয়। তারপরও যদি অতিরিক্ত ছাল থেকে থাকে তা হাতের সাহায্যে পরিষ্কার করা হয়। এরপর কাসাভাগুলো মেশিনের সাহায্যে পেস্ট বানানো হয়। তারপর পেস্ট থেকে পানি ঝরিয়ে নিয়ে মেশিনে শুকানোর পর আটা তৈরি করা হয়। এবং আটা থেকে চালুনি দ্বারা বাড়তি ময়লা আলাদা করে নেয়া হয়।
তবে কাসাভা আটা দ্বারা সরাসরি কোনো খাবার তৈরি করা একটু ঝামেলার। সেকারণে এই আটার সাথে অন্য আটা মিশিয়ে খাবার তৈরি করা হয়।
পুষ্টিগুণ
কাসাভার খাদ্যমানের মধ্যে যা যা আছে- প্রোটিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড, কার্বোহাইড্রেট, ফ্রুকটোজ, গ্লুকোজ। তাছাড়া এর প্রতি ১০০ গ্রাম কাসাভা আলুতে রয়েছে ৩৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৩৭ গ্রাম শর্করা, ০.৩ গ্রাম চর্বি, ৩৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৭ মিলিগ্রাম আয়রন, ০.০৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন এ, ১.২ গ্রাম আমিষ এবং ১৪৬ ক্যালরি খাদ্যশক্তি। এর প্রায় ৯০ শতাংশ শর্করাই থাকে উন্নত স্টার্চ হিসেবে।
কাসাভার ঔষধি গুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে
এতে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিগুণ সহ সেলুলোজের সঙ্গে মিনারেল ও ফাইবার গ্লুটামিনও পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস উপশমে এর আঠালো অংশ বেশ কার্যকরী। নিয়ম করে কাসাভা গ্রহণ করলে যারা ডায়াবেটিস রোগী বা ভবিষ্যতে এই রোগ হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, তারা এটাকে এড়াতে পারেন।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে
কাসাভাতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বিদ্যমান। যা হার্টকে সুস্থ রেখে সব ধরনের হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে কাজ করে৷ তাছাড়া হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক সহ নানা রকম রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এলডি এলের মত খারাপ কোলেস্টেরল কমাতেও কাসাভায় থাকা ফাইবার কাজ করে। তাছাড়া বাড়তি ফাইবার কোলেস্টরলের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে। এতে কোলেস্টেরলের পরিমাণ নেই বললেই চলে।
দেহের টিস্যুগুলো সুস্থ রাখতে
কাসাভায় থাকা বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন, যেমন- লাইসিন, আইসোলিউসিন, ভ্যালিন শরীরের টিস্যু মেরামত ও রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয়, যদি সঠিকভাবে পরিমিত কাসাভা খাওয়া হয় তাহলে দেহের টিস্যুগুলো সুস্থ থাকার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুগুলো সুস্থ হতে পারে।
হাড় গঠনে সহায়ক
আমাদের শরীরের হাড় ভালো রাখতে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। যা কাসাভায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। তাছাড়া ভিটামিন কে এর উপস্থিতি বিদ্যমান থাকায়, অস্টিওপরোসিস, আলঝেইমার্সের মত রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। শুধু তাই নয়, কাসাভা প্রবীণ বয়সেও দেহের হাড় মজবুত রাখতে সহায়তা করে থাকে।
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পটাশিয়াম প্রয়োজন, যা কাসাভায় রয়েছে। ফলে তা হাইপারটেনশনের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
এগুলো ছাড়াও এটি ওজন কমাতে ও হজমে সহায়তা করে। ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে এতে থাকা বিভিন্ন ধরনের এন্টি অক্সিডেন্টের উপস্থিতি।
তবে খাদ্য হিসেবে এর বাজার না বাড়লেও শিল্পখাতে এর ব্যাপক ব্যবহার বাড়ছে। যার ফলে এর আবাদও বাড়ছে। তবে চাষপদ্ধতি, জমির ধরণ এবং বাজারজাতকরণ ভাল না হওয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়ায় সম্ভবনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কাপড়ের মাড় তৈরিতে বস্ত্র শিল্পে এর প্রয়োজন অনেক। তবে বাংলাদেশকে এসব উপাদান অনেকাংশেই আমদানি করতে হয়।
কাসাভা স্টার্চের বার্ষিক চাহিদা বাংলাদেশে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টন। তবে দেশে মাত্র ৫/৬ হাজার টন উৎপাদিত হয়। তাছাড়া এর চাহিদা বাড়ছে প্রতি বছর দশ/পনেরো শতাংশ হারে।
কাসাভা চাষে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলেও ঘাটতি রয়েছে অনেক। যার ফলে চাষিরা যথার্থ মূল্য পায় না।