ক্লাউড সিডিং Cloud seeding
প্রচণ্ড গরমে সবার যখন ত্রাহি অবস্থা, তখন স্বস্তি হয়ে দেখা দেয় বৃষ্টি। চাইলেই কী আর বৃষ্টি পাওয়া যায়, সেটা যদি সম্ভব হতো তাহলে কেমন হত? বিজ্ঞানীরা সেই চেষ্টাই দশকের পর দশক ধরে করে যাচ্ছেন।
ক্লাউড সিডিং কি
ক্লাউড সিডিং বলতে এক ধরনের আবহাওয়া পরিবর্তনকেই বুঝায়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বা ধরন পরিবর্তন করাই যার লক্ষ্য। আরও সহজ করে বলতে গেলে, শিলাবৃষ্টি প্রশমিত করা বা কুয়াশা ছড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ বৃষ্টি বা তুষার বাড়ানো অথবা বৃষ্টিপাত রোধ করা। মোটকথা, কৃত্রিম বৃষ্টিপাত হল প্রকৃতির উপর জোর করে বৈজ্ঞানিক প্রভাব খাটিয়ে বৃষ্টি নামানোর একটি প্রক্রিয়া মাত্র।
আবিষ্কারের ইতিহাস
১৮৯১ সালে সর্ব প্রথম লুই গাথমান কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টিতে তরল কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। বার্গারন- ফাইন্ডিসন ১৯৩০ এর দশকে বরফের স্ফটিক কণার উপস্থিতিতে অতীব ঠান্ডা পানি দিয়ে একটি পরীক্ষামূলক গবেষণা করেন। যাতে করে পানি-কণা জমে এবং বৃষ্টি নামে। বিজ্ঞানীরা এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই তত্ত্বটি তৈরি করেন। জেনারেল ইলেকট্রিকের গবেষক ভিনসেন্ট শিফার এই তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৬ সালের জুলাইতে তিনি কৃত্রিম বৃষ্টির মূলনীতি আবিষ্কার করেন। পরে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আরভিং ল্যাংমুর সঙ্গে যৌথভাবে কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন।
ক্লাউড সিডিং এর উপাদান
ক্লাউড সিডিং এ সাধারণ সিলভার আয়োডাই্জ্ড, পটাশিয়াম আয়োডাই্জ্ড অথবা শুষ্ক বরফ বা কঠিন কার্বন ডাই-অক্সাইড রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এছাড়া তরল প্রোপেন গ্যাসও ব্যবহার করা হয়। এ গ্যাস সিলভার আয়োডাই্জ্ড এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় বরফের স্ফুটিক তৈরি করতে পারে। তবে অনেক সস্তা ও বেশ কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় এ কাজে এখন সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাবার লবণের ব্যবহার বাড়ছে।
ব্যবহারের প্রক্রিয়া
মেঘের ভেতরের তাপমাত্রা ক্লাউড সিডিং এর সময় ২০ থেকে -৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। তুষারপাতের পরিমাণ এ সময় বেড়ে যেতে পারে। এই রকম পরিস্থিতিতে রাসায়নিক হিসেবে সিলভার আয়োডাইড ব্যবহার করা হয়। ক্লাউড সিডিং এর উপাদানগুলো উপযুক্ত স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে করে অথবা বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে। যখন উড়োজাহাজটি মেঘের ভেতর দিয়ে যায় তখন সিলভার আয়োডাই্জ্ড ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মেঘের- সিড হিসেবে রাসায়নিকের ক্ষুদ্র স্ফটিক দানাগুলোই কাজ করে। অর্থাৎ ভাসমান জলীয় বাষ্পে পানির কণাগুলো এসব দানায় জড়ো হয়ে বড় ফোঁটায় পরিণত হয়। ওজন বেড়ে গিয়েই একসময় মহাকর্ষের টানে বৃষ্টি ঝরে পড়ে। সাধারণত রকেটে বা বিমানে করে এই ড্রাই-আইস গুলো মেঘের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। মিসাইল পদ্ধতিও বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ক্লাউড সিডিং এর ধাপ
ক্লাউড সিডিং করতে গিয়ে এমন পদার্থগুলিকে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয়,যেগুলো মেঘকে ঘনীভূত করতে বা বরফের নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে।
এই প্রক্রিয়াটি ঘটানোর জন্য তিনটি ধাপ পার করতে হয়।
প্রথমত: মেঘ সৃষ্টি করতে হয় বা আকাশে মেঘ থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত: বৃষ্টিপাতের উপযোগী অবস্থায় আনতে হলে মেঘকে ঘনীভূত করতে হয়।
তৃতীয়ত: সবশেষে বৃষ্টি ঝরানো হয়।
আকাশের ভাসমান মেঘকে পানির ফোটায় পরিণত করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। এই ক্লাউড সিডিং কনসেপ্ট হিসেবে কয়েক দশক ধরে প্রচলিত আছে।
ক্লাউড সিডিং বৃদ্ধির কারণ
বিশ্বের অনেক দেশেই এখন ক্লাউড সিডিং ঘটানো হচ্ছে। কেননা যতদিন যাচ্ছে, পানির অভাব যেন বেড়েই যাচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৪৫ শতাংশ জনসংখ্যাই প্রচণ্ড পানির সংকটে ভুগছেন। পানি সেচের কারণে পানির অভাব যেন আরও বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০-২৫ বছরের মাঝে বিশ্বের প্রায়ই দেশ তীব্র পানির সংকটে ভোগার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই প্রযুক্তির মাধ্যমে খরা প্রবণ এলাকায় কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানো বা নামানো হচ্ছে। তাছাড়া যে সব এলাকাতে অতি দৃষ্টিজনিত কারণে বন্যা হচ্ছে, তার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলোর পাশাপাশি যে সব স্থানের ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত, কৃত্রিম বৃষ্টিপাত সেসব স্থানের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এ কারণেই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য সেসব স্থানে সার্বক্ষণিক মেঘ পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। যেমন মেঘ থাকলে বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব হয় তেমন খুঁজে পেলেই ক্লাউড সিডিং অপারেশন শুরু করা হয়।
কৃত্রিম বৃষ্টিপাত বা ক্লাউড সিডিং বিশ্বের যে সব দেশ এখন পর্যন্ত ঘটিয়েছে তার মাঝে চীন একাই তার চেয়ে বেশি করিয়েছে। বেইজিং অলিম্পিকে চীন ২০০৮ সালে এই পদ্ধতিতে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছিল। ক্লাউড সিডিং এর মাধ্যমে খেলার মাঠে মেঘ জড়ো হওয়ার আগেই খেলার মাঠ থেকে দূর কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছিল। ফলে বৃষ্টি খেলার মাঝে বিঘ্ন ঘটায়নি।
ক্লাউড সিডিং এর প্রভাব
আমরা জানি, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। তাই এক জায়গায় কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটালে অন্য জায়গায় তার প্রভাবে বৃষ্টির অভাব সৃষ্টি হবে।
কেননা, অনেক এলাকায় কৃত্রিম বৃষ্টিপাত করানোর জন্য আকাশে সিলভার আয়োডাই্জ্ড ছিটানো হতো। এর পরিমাণ যদি অতিরিক্ত হয়, তাহলে মাটি দূষিত হবে। শুধু তাই নয়, এর প্রভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক কথায়, বাস্তুসংস্থানেও ওপরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। এ কারণেই অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের দ্বারা খুব সাবধানে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়।
ক্লাউড সিডিং নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানীদের ধারণা
তবে এই প্রযুক্তি অনেক ব্যয়বহুল। এজন্য ব্যয়ভার কমানোর জন্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেই যাচ্ছেন। তাদের ধারণা, বিমান বা রকেটের পরিবর্তে লেজার রশ্মির ব্যবহার করে যদি ক্লাউড সিডিং করানো হয় তবে ব্যয় কমে যাবে। যদি লেজার রশ্মির ব্যবহার আবিষ্কৃত হয়, তাহলে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রযুক্তিকে আরও সহজ ও সুলভ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই প্রকৃতির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এসেছে। এরই ফলে কখনো ডেকে এনেছে আশীর্বাদ আবার কখনো বা ডেকে এনেছে চরম বিপর্যয়। দিনে দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উন্নয়ন ঘটছে তাতে ধারণা করাই যায়, ভবিষ্যতে প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।