রোজা কথাটি শুনলেই মুসলিমদের মাঝে এক ধর্মীয় অনুভূতি কাজ করে। যা আরবি রমজান মাসে হয়ে থাকে। রোজা শব্দটি ফারসি শব্দ থেকে এসেছে। আর এটির আরবি শব্দ সিয়াম। সিয়াম বহুবচন হলেও সাওম হলো এর একবচন। যার আবিধানিক অর্থ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া।
ইসলামের পাঁচটি রুকুনের মাঝে রোজা অন্যতম। এটি মুসলিমদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী বিশ্বের সব মুসলমানরা রোজা রাখলেও ভৌগোলিক কারণে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময়ের মাঝে পার্থক্য দেখা দেয়। এজন্য রোজা রাখার সময়ও কমবেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতি বছর রোজা ১০-১২ দিনের ব্যবধান হয় আরবি দিনপুঞ্জ অনুযায়ী। কেননা, আরবি মাস চাঁদের উপর নির্ভরশীল।
আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২৪ সালের রমজানে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরটির মুসলিমদের সবচেয়ে ছোট দিন রোজা রাখতে হবে অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। আর গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুউকের মুসলিমদের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রোজা রাখতে হবে অর্থাৎ ১৭ ঘণ্টা ৫২ মিনিট।
আবার বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতি অনুযায়ী আলাদা কিছু রীতি পালনও হয়ে থাকে।
১. তুরস্ক
রমজানের সময় তুরস্কের কিছু নিয়ম বাংলাদেশের সাথে বেশ পরিচিত। তুরস্কে সেহরির আগে মানুষজনকে জাগিয়ে তোলার জন্য মসজিদের মাইক ব্যবহার করে। আবার তরুণদের হাক-ডাকে অনেক এলাকায় মুসলিমদের জাগানোর প্রথাও রয়েছে। আর এই প্রথাটি বাংলাদেশেও প্রচলিত আছে।
তুর্কিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে তরুণরা ঢোল পিটিয়ে মানুষজনকে জাগিয়ে তোলে। এই ঢোলটির নাম হলো ‘দাভুল’। আকারে এটি বেশ বড় হয়ে থাকে আর দুই দিকেই বাজানো যায়। তাই এর শব্দ যেমন বেশি হয় তেমনি অল্প সময়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষজনকে জাগানো সহজ হয়। এ কাজের জন্য তারা কিছু বখশিস পায় এবং সেহরিতে একসঙ্গে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণও পায়।
এই প্রথা কিছুটা আলবেনিয়ার রোমা মুসলিমদের মাঝেও লক্ষ্য করা যায়। এই জাগানোর কাজটি তারা লোদ্রা নামের ঐতিহ্যবাহী ড্রামের মাধ্যমে করে থাকে। তবে তারা ড্রাম বাজানাের সাথে সাথে গীতিনাট্যও পরিবেশন করে থাকেন। এ বছর তুরস্কের মুসলিমরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা সময় ধরে রোজা রাখবেন।
২. মিশর, জর্ডান ও মরক্কো
তুরস্কের ন্যায় মিশর ও জর্ডানেও এলাকাভিত্তিক কিছু মানুষ এই জাগানোর কাজটি করে থাকে। এরাও ঢোলের মৃদু শব্দের সঙ্গে ডেকে ডেকে মানুষজনকে জাগান।
একই কাজ মরক্কোতেও করা হয়। মিশর ও জর্ডানে এদের নাম মেসাহারাতি হলেও মরক্কোতে এদের ডাকা হয় নাফারস। তবে মরক্কোতে এসব লোক তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘গান্দোরা’, টুপি এবং একজোড়া চপ্পল পরে এবং প্রার্থনার সুরে ধীর গতিতে হাঁটতে থাকে। মরক্কোতে এই ব্যক্তিদের সম্মানী দেওয়া হয়।
মিশরে রমজানের ঐতিহ্যগুলির মধ্যে একটি ‘ফানুস’। এটি বিশ্বের সবচেয়ে রঙিন এবং সুন্দর ঐতিহ্য। এই ‘ফানুস’গুলো মূলত ধাতু ও রঙিন কাঁচ দিয়ে উজ্জ্বল রঙের প্রদীপ বা লণ্ঠন। এই ঐতিহ্যের উৎপত্তি হয়েছিল ফাতেমীয় সাম্রাজ্য থেকে।
এই ঐতিহ্যে রাস্তা, বাড়ি এবং পাড়া এই লণ্ঠন দিয়ে আলোকিত করা হয়। এই ঐতিহ্য মিশরীয় রমজানের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এ বছর মিশর, জর্ডান ও মরক্কোর মুসলিমরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন।
২. মিশর, জর্ডান ও মরক্কো
তুরস্কের ন্যায় মিশর ও জর্ডানেও এলাকাভিত্তিক কিছু মানুষ এই জাগানোর কাজটি করে থাকে। এরাও ঢোলের মৃদু শব্দের সঙ্গে ডেকে ডেকে মানুষজনকে জাগান।
একই কাজ মরক্কোতেও করা হয়। মিশর ও জর্ডানে এদের নাম মেসাহারাতি হলেও মরক্কোতে এদের ডাকা হয় নাফারস। তবে মরক্কোতে এসব লোক তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘গান্দোরা’, টুপি এবং একজোড়া চপ্পল পরে এবং প্রার্থনার সুরে ধীর গতিতে হাঁটতে থাকে। মরক্কোতে এই ব্যক্তিদের সম্মানী দেওয়া হয়।
মিশরে রমজানের ঐতিহ্যগুলির মধ্যে একটি ‘ফানুস’। এটি বিশ্বের সবচেয়ে রঙিন এবং সুন্দর ঐতিহ্য। এই ‘ফানুস’গুলো মূলত ধাতু ও রঙিন কাঁচ দিয়ে উজ্জ্বল রঙের প্রদীপ বা লণ্ঠন। এই ঐতিহ্যের উৎপত্তি হয়েছিল ফাতেমীয় সাম্রাজ্য থেকে।
এই ঐতিহ্যে রাস্তা, বাড়ি এবং পাড়া এই লণ্ঠন দিয়ে আলোকিত করা হয়। এই ঐতিহ্য মিশরীয় রমজানের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এ বছর মিশর, জর্ডান ও মরক্কোর মুসলিমরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন।
৩. ইরাক
রমজানে ইরাকিরা তাদের অন্যতম প্রধান একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা খেলেন ‘মেহাবেস’। এর অন্য নাম হলো আংটি খেলা।
তারা মনে করেন, সারাদিনের সংযমের সঙ্গে রোজা পালন করে ইফতারের পর যদি হালকা মজা করা যায় তাতে কোনো ক্ষতি নেই।এ খেলায় ৪০ থেকে ২৫০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে।খেলার সময় অংশগ্রহণকারীরা দুটো দলে ভাগ হয় এবং একটি দল আংটি লুকিয়ে রাখে তো অন্যদল আংটিটি কার কাছে আছে তা খোঁজার কাজ করে। এ খেলায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নিতে পারে। তবে তারা ঘরের ভেতর থেকে।
যুদ্ধের কারণে খেলাটি অনেক বছর বন্ধ ছিল। তবে ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে ইরাকিরা আবারও শুরু করেন।
এ বছর ইরাকের মুসলিমরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন।
৪. লেবানন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইফতার স্বভাাবিকভাবে হলেও লেবাননে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এখানে কামানের তোপধ্বনি দিয়ে ইফতারের সময় জানানো হয়। এটি প্রাচীনতম ঐতিহ্যের একটি।
এটি প্রায় ২০০ বছর পুরনো হলেও আজও লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ এই রীতি চালু রেখেছে। এটি ‘মিদফা আল ইফতার’ নামিই বেশ পরিচিত।
মনে করা হয়, এই প্রথার উদ্ভব মিশর থেকেই। তৎকালীন শাসক খোশ কদম কোন এক রমজান মাসে ভুলক্রমে সূর্যাস্তের সময় কামানের একটি গোলা ছোঁড়েন।
এই শব্দ পুরো কায়রো শহর জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। আর মুসলিমগণ একে মনে করেন রোজা শেষ হবার সংকেত। পরবর্তীতে এই ভুলকেই সবাই খুব প্রশংসা করে। পরবর্তিতে ঐতিহ্যে পরিণত হয় কামানের এই তোপধ্বনি।
লেবানন ছাড়াও তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও কামানের তোপধ্বনি সেহরি ও ইফতারের সময় দেয়া হয়। বর্তমানে এই ঐতিহ্য প্রায় হারানোর পথে।
এ বছর লেবাননের মুসলিমরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন।
৫. সংযুক্ত আরব আমিরাত
‘হক আল লায়লা’ নামের এক বিশেষ আয়োজন চালু রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। যা রমজান শুরু হবার আগেই আয়োজন করা হয়। অর্থাৎ রমজানের ঠিক আগের মাস, ১৫ই শাবান মাসে। শিশুরা এই দিনটিতে রঙিন কাপড় পড়ে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।
এসময় শিশুরা প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে মিষ্টি সংগ্রহ করে খারিতা নামক ব্যাগে। আর এ কাজ করার সময় তারা সুর করে বলে “আতোনা আল্লাহ ইউতিকোম, বাইত মক্কা ইউদিকুম। যার বাংলা অর্থ ” আল্লাহ আপনাদের পুরস্কৃত করবেন এবং মক্কা পরিদর্শনের তৌফিক দান করবেন যদি আপনারা আমাদেরকে দেন”।
প্রতি বছর ধর্মীয়ভাবে পালন করা ‘হক আল লায়লা’ সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজানের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। যার উদ্দেশ্যই রমজানের গুরুত্ব সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।
কুয়েতেও এটি পালন করা হয়। তবে রমজানের মাঝামাঝি তিন দিনে পালন করা হয়। কুয়েতে এই ঐতিহ্যটি ‘গারগিয়ান’ নামে পরিচিত।
এ বছর প্রায় ১৩ ঘণ্টা সময় ধরে রোজা রাখবেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুসলিমরা ।
৬. ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের মুসলমানদের মাঝে ‘পাদুসান’নামে একটি পদ্ধতি চালু আছে। যা রমজানের আগেই পালিত হয়। যার অর্থ গোসল করে নিজেদের শুদ্ধ করা।এই পদ্ধতি হয় আশেপাশের প্রাকৃতিক পুকুরে।
এখানকার মুসলিমরা বিশ্বাস করেন এই সাংস্কৃতিক চর্চা রমজান মাসে তাদের শুদ্ধ করে। ইদানীং সময়ে অনেকেই এই সাংস্কৃতি নিজ বাড়িতেই করে থাকেন।
এ বছর ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা প্রায় ১৩ ঘণ্টা সময় ধরে রোজা রাখবেন।
৭. দক্ষিণ এশিয়া
বাংলাদেশেরও কিছু এলাকায় সেহরির আগে মানুষজনকে জাগিয়ে তোলার জন্য মসজিদের মাইক ব্যবহার করে। আবার কিছু এলাকায় কাফেলা দলও লক্ষ্য করা যায়। যারা মানুষজনকে সেহরির জন্য ঘুম থেকে জাগানোর কাজ করে থাকে।
তাছাড়াও বাংলাদেশের রমজানে ইফতারের রকমারি আয়োজন বেশ চোখে পড়ে। এই বাহারি ইফতারের আয়োজন যেন কিছুটা সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। আর এই ইফতারের মূল আকর্ষনই যেন ছোলা। যা ছাড়া ইফতার যেন ভাবতেই পারেনা বাংলাদেশের মুসলিমরা।
রমজানের শেষ দিন যখন চাঁদ ওঠে তখন উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রমযানের শেষ সন্ধ্যা ‘চাঁদ রাত’ নামে পরিচিত।
ঈদের আগে শেষ মুহূর্তে এই চাঁদরাতে কেনাকাটা চলে এবং নারীরা হাতে মেহেদি লাগায়। উৎসবের অংশ হিসেবে চলে নানা আয়োজন। তবে শহর এবং গ্রামের ক্ষেত্রে এই আয়োজন ভিন্ন ভিন্ন হয়।
বাংলাদেশি মুসলিমরা এ বছর রমজানে প্রায় ১৩ ঘণ্টা ১৩ মিনিট থেকে শুরু হয়ে ১৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট পর্যন্ত সময় ধরে রোজ পালন করবেন।
এছাড়াও
১৬ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন যে দেশের মুসলিমরা-
আইসল্যান্ড।
১৫ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন যে দেশের মুসলিমরা-
স্কটল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও কাজাখস্তান।
১৪ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন যে দেশের মুসলিমরা-
সুইডেন, রোমানিয়া, ইতালি, বুলগেরিয়া, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, কানাডা, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, জাপান, গ্রিস, নিউইয়র্ক সিটি, ওয়াশিংটন ডিসি, লস অ্যাঞ্জেলস, তিউনিসিয়া, সিরিয়া, আলজেরিয়া ও ইরান।
১৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে রোজা রাখবেন যে দেশের মুসলিমরা-
কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, প্যারাগুয়ে, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, অ্যাঙ্গোলা, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, ইথিওপিয়া, আর্জেন্টিনা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, উরুগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, চিলি ও নিউজিল্যান্ড।