Wednesday, March 12, 2025
spot_imgspot_img
HomeBD Info Categoryজিরা (Cumin)কেন খাবেন? রান্নায় স্বাদ ও স্বাস্থ্যে অনন্য, তবে থাকতে হবে...

জিরা (Cumin)কেন খাবেন? রান্নায় স্বাদ ও স্বাস্থ্যে অনন্য, তবে থাকতে হবে সতর্ক

বাংলা “জিরা” বা “জীরা” নামের উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত শব্দ জীরক থেকে। 

জিরা হলো একটি সুপুষ্পক উদ্ভিদ। এর গাছ এক বর্ষজীবী বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। এর গাছগুলো প্রায় ৩০–৫০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। কাণ্ড সরু, রোমহীন ও শাখান্বিত। ফুল সাদা বা গোলাপি রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর প্রতি পুষ্পছত্রে পাঁচ থেকে সাতটি পুষ্প থাকে। কাণ্ডের রং ধূসর থেকে কালচে সবুজ হয়। আর পাতা ৫–১০ সেমি (২–৪ ইঞ্চি) লম্বা হয়। জিরা মূলত শুকনো বীজ। যা লম্বা ৪–৫ মি.মি. পর্যন্ত হয়। তবে এর বীজগুলো থাকে  জিরা বা ফলের ভেতরে। এই ফলগুলো হলো দ্বিগর্ভপত্রী। আর প্রতিটি গর্ভপত্রে একটি করে বীজ থাকে। এবং প্রতিটি বীজে তৈল নালিসহ আটটি খাঁজ থাকে।

ইতিহাস

পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লেভান্তে প্রথম জিরার খোঁজ পাওয়া যায়। তাছাড়া সিরিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে জিরার বীজও পাওয়া গেছে। হাজার বছর আগে থেকেই জিরা মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় জিরা মশলা এবং মমীকরণে সংরক্ষক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

প্রাচীন গ্রিসে একটি প্রথা ছিল, ওখানকার অধিবাসীরা খাওয়ার সময় টেবিলে কৌটায় করে জিরা রাখত। এই প্রথা আজও আধুনিক মরক্কোতে প্রচলিত আছে। আর ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক হাজার বছর ধরে রান্নার উপকরণ হিসেবে জিরার ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে আমেরিকা অঞ্চলে স্প্যানীয় ও পর্তুগিজ ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে জিরা পরিচিতি লাভ করে। পারস্য রন্ধনশৈলীতে কালো ও সবুজ দু’ধরণের জিরা ব্যবহার করা হয়। 

চাষাবাদ

জিরা মূলত খরা-সহিষ্ণু ও ক্রান্তীয় বা উপক্রান্তীয় অঞ্চলের ফসল। তবে জিরা চাষের জন্য প্রয়োজন হয় তিন থেকে চার মাস দীর্ঘ উষ্ম গ্রীষ্মকালের। কেননা, তাপমাত্রা কম হলে জিরার পাতা সবুজ থেকে বেগুনি বর্ণের হয়ে যায়। আবার বেশি তাপমাত্রায় জিরার বর্ধনশীল মৌসুমের সময় কমে আসে। যার কারণে ফল তাড়াতাড়ি পেকে যায়।এজন্য  জিরা উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ হলো  ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু। আর তাপমাত্রা হলো ২৫ থেকে ৩০ °সে। 

চাষের সময়

জিরা রোপণ করা শুরু হয় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। আর ফসল তোলা শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। সিরিয়া ও ইরানে জিরা রোপণ করা হয় মধ্য-নভেম্বর থেকে মধ্য-ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে রোপণের সময়টা মধ্য-জানুয়ারি পর্যন্তও হতে পারে। আর উত্তোলন করা হয় জুন-জুলাই মাসে। বর্তমানে জিরার সিংহভাগ চাষ হয় ভারতীয় উপমহাদেশ, উত্তর আফ্রিকা, মেক্সিকো, চিলি ও চীনে। এখন বাংলাদেশের বান্দরবান ও নওগাঁয়ে জিরার চাষ হচ্ছে।

ইতিহাস থেকে শুরু করে খাবার টেবিলে জিরা মসলা হিসেবে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।  

কেননা, জিরায় রয়েছে প্রচুর পুষ্টি উপাদান। উচ্চ পরিমাণে চর্বি, আমিষ ও খাদ্য আঁশ পাওয়া যায় এতে। এছাড়াও ভিটামিন বি, ই, খনিজ পদার্থ, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাংগানিজ রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। এখন আমরা জিরার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো-

পুষ্টিগুণ

১. হজমশক্তি বাড়াতে কাজ করে

জিরা হজমশক্তি বাড়াতে দারুণ কাজ করে । হজমে সমস্যা থাকলে দিনে তিনবার জিরা দিয়ে চা পান করুন। উপকার মিলবে।

২. ঘুম ভাল হতে সহায়তা করে

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক চামচ কলার পেস্টের সাথে আধা চামচ জিরার গুঁড়া মিশিয়ে খেয়ে নিন। ফলে মস্তিষ্কে মেলাটোনিন নামে কেমিক্যালের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই কেমিক্যাল ভালো ঘুম হতে সহায়তা করে।

৩. ওজন কমাতে সহায়ক

জিরা পানির সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে সহজেই ওজন কমে। তাছাড়া  রাতে এক কাপ পানিতে জিরা ও কয়েক কুচি আদা  ভেজিয়ে রাখে সকালে ছেঁকে সেই পানি খেয়ে নিন। এভাবে প্রতি সপ্তাহে ৩ দিন করে পান করুন উপকার পাবেন। 

টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে

জিরা ভেজানো পানিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। যা শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে কাজ করে। যার কারণে অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলি সুস্থভাবে পরিচালিত হয়।

৪. অ্যানিমিয়ার চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী

জিরার মাঝে থাকা আয়রন অ্যানিমিয়ার চিকিৎসায় কাজ করে। শরীরের লাল রক্ত কোষ তৈরি হতেও আয়রন লাগে। তাছাড়া এটি রক্তে অক্সিজেন সরবরাহের কাজ করে।

৫. শ্বাসযন্ত্র উন্নত করতে ভূমিকা রাখে

জিরার মধ্যে থাকা অ্যান্টি-কনজেসটিভ উপাদানটি সর্দি কাশির জীবাণুকে শেষ করে দেয়। প্রতিদিন এক গ্লাস জিরা ভেজানো পানি যদি খাওয়া যায় তাহলে বুকের সমস্যার সমাধান হতে পারে।

৬. স্মৃতিশক্তি বাড়াতে কাজ করে

জিরে পানির আর একটি গুণ হলো এটি মস্তিষ্কের শক্তি অর্থাৎ স্মৃতিশক্তির মান উন্নত করতে সাহায্য করে।

৭. ত্বকের ময়লা পরিষ্কারে ভাল কাজ দেয়

জিরেতে রয়েছে ফাইবার এবং মুক্ত র‍্যাডিকেল। যা শরীরকে ডেটোক্সিফাই করতে কাজ করে। আর এই মুক্ত র‍্যাডিক্যাল ত্বককে পরিষ্কার করে ত্বককে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা এনে দেয়। শুধু তাই নয়, এটি ব্রণের চিকিৎসার জন্যও উপকারী। 

৮. জ্বরের প্রকোপ কমায়

জিরা ঠান্ডা লাগা বা জ্বরের প্রকোপ কমাতে কাজ করে। কেননা, এতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি প্রপার্টিজ। যা প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাজ করে। যার ফলে ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ কমে। 

জিরা শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ায় না, এটি পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। এতে রয়েছে নানা ধরনের ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা করে। নিচে প্রতি ১০০ গ্রাম জিরার পুষ্টিগুণ দেওয়া হলো—

প্রধান পুষ্টি উপাদান (প্রতি ১০০ গ্রাম জিরায়)

শক্তি: ৩৭৫ ক্যালরি
প্রোটিন: ১৭.৮ গ্রাম
ফ্যাট (চর্বি): ২২.৩ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট: ৪৪.২ গ্রাম
ফাইবার: ১০.৫ গ্রাম

ভিটামিন ও খনিজ

ভিটামিন এ: চোখের স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে
ভিটামিন সি: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ভিটামিন ই: ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখে
ভিটামিন বি৬: মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করে
ক্যালসিয়াম: হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়ক
আয়রন: রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়, রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে
ম্যাগনেসিয়াম: পেশি ও স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করে
ফসফরাস: হাড় ও কোষের সুস্থতায় সহায়ক
পটাশিয়াম: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
জিঙ্ক: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

জিরা সাধারণত স্বাস্থ্যকর এবং উপকারী, তবে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। নিচে জিরার সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো তুলে ধরা হলো—

১. হজমের সমস্যা

  • অতিরিক্ত জিরা খেলে পেট ফাঁপা, গ্যাস্ট্রিক, এবং অম্বল হতে পারে।
  • এটি অ্যাসিড উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়ে পেটে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।

২. নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা

  • জিরা রক্তচাপ কমানোর ক্ষমতা রাখে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য উপকারী হলেও, কম রক্তচাপ (হাইপোটেনশন) থাকলে এটি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

৩. রক্তপাতের ঝুঁকি

  • জিরায় অ্যান্টি-কোয়াগুলেন্ট (রক্ত পাতলা করার) বৈশিষ্ট্য আছে, যা বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অস্ত্রোপচারের আগে এটি এড়িয়ে চলা ভালো।

৪. লিভারের সমস্যা

  • দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত জিরা গ্রহণ করলে লিভারের কার্যক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষত জিরার এসেনশিয়াল অয়েল বেশি শরীরে প্রবেশ করলে।

৫. শর্করা নিয়ন্ত্রণে প্রভাব

  • এটি রক্তের শর্করার মাত্রা কমাতে পারে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কখনো কখনো সমস্যার কারণ করতে পারে।

৬. এলার্জি ও চর্মরোগ

  • সংবেদনশীল ত্বকে জিরার তেল ব্যবহার করলে জ্বালা, লালচে ভাব, বা অ্যালার্জি হতে পারে।
  • কিছু ক্ষেত্রে খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করলে ত্বকে র‍্যাশ বা চুলকানি দেখা দিতে পারে।

৭. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের জন্য ঝুঁকি

  • জিরা মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করতে পারে, ফলে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত জিরা গ্রহণ গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
  • স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য এটি কখনো কখনো দুধ উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে।

সঠিক উপায়ে জিরা খাওয়ার পরামর্শ

  • দৈনিক ১-২ চা চামচের বেশি জিরা না খাওয়াই ভালো।
  • যদি কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, লো ব্লাড প্রেসার বা ডায়াবেটিস রোগীরা নিয়মিত জিরা খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে, জিরা শুধু একটি সাধারণ মসলা নয়, এটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করে। হজমশক্তি বাড়ানো, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা, রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ, ওজন কমানো, ও চর্ম ও চুলের যত্নে জিরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে, অতিরিক্ত গ্রহণ করলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন হজমজনিত সমস্যা, নিম্ন রক্তচাপ, বা রক্তপাতের ঝুঁকি। তাই জিরা উপকারী হলেও পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সঠিকভাবে ও পরিমাণমতো জিরা ব্যবহার করলে এটি স্বাস্থ্যের জন্য একটি প্রাকৃতিক আশীর্বাদ হতে পারে। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এই মসলাটি যুক্ত করে সুস্থ ও সতেজ জীবনযাপন সম্ভব। 😊

জিরা নিয়ে জানতে নিচের ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন…

আরো দেখুন

  1. এলাচের যত গুণ, জানলে অবাক হবেন
  2. হার্ট ও চোখ ভালো রাখতে চান, ফুলকপি খান
  3. Lemon: লেবু কেন খাবেন?
  4. রমজানের মূল আকর্ষণ ছোলা, কিছু কার্যকরী অবদান তবে সাবধান!
    5. চিয়া সীডের (Basil Seed) আশ্চার্যজনক কিছু গুণ

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Elliana Murray on ONLINE SHOPPING
Discover phone number owner on Fake app চেনার উপায়